ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে সাবেকি উদারনীতিবাদ তার গুরুত্ব অনেকটা হারিয়ে ফেলে। এই সময় টি. এইচ. গ্রিন, ম্যাক্আইভার এবং ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিবাচক ধারণা নিয়ে উদারনীতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। একে ইতিবাচক বা আধুনিক উদারনীতিবাদ (Positive or Modern Liberalism) বলা হয়।
উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো ।
1. রাষ্ট্র সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ: ইংল্যান্ডের ভাববাদী দার্শনিক টি. এইচ. গ্রিন বলেন, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, বলপ্রয়োগ নয় (Will, not force, is the basis of the State.)। গ্রিন রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন।
গ্রিনের মতে, রাষ্ট্র কখনও নিজেই নিজের লক্ষ্য হতে পারে না। রাষ্ট্র হল ব্যক্তিবর্গের পূর্ণ নৈতিক বিকাশের হাতিয়ার মাত্র। গ্রিনের অভিমত তাঁর “সাধারণ ইচ্ছা”র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
তিনি মনে করতেন সাধারণ ইচ্ছা তথা সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠার জন্যই স্বাধীনতার প্রয়োজন। রাষ্ট্র এই সদিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। রাষ্ট্র এর প্রতিবন্ধকতাসমূহ অপসারণ করবে। তাঁর মতে, নাগরিকরা নিজেদের স্বার্থরক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে না।
অবশ্য স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করাকে তিনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
2. বন্ধুবাদী দৃষ্টিতে রাষ্ট্র: আধুনিক উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্আইভার, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ব্যক্তির বহুমুখী জীবনের সম্পূর্ণ বিকাশ রাষ্ট্র একা করতে পারে না।
এজন্য মানুষ সমাজের অভ্যন্তরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সংঘ বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে থাকে। রাষ্ট্রের মতো এইসব সংঘ বা প্রতিষ্ঠানগুলি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন। এদেরও রাষ্ট্রের মতো সার্বভৌম ক্ষমতা থাকা উচিত।
বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করলেও অন্তর্জীবনের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
ম্যাক্আইভারের ভাষায়, ‘পেনসিল কাটার জন্য কুঠার যেমন অনুপযুক্ত, সেরকম ব্যক্তির অন্তর্জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির বিকাশে রাষ্ট্রও অনুপযুক্ত।’
3. রাষ্ট্র জনগণের সেবক: অধ্যাপক ম্যাক্আইভারের মতে,রাষ্ট্র জনগণের সেবা করে বলেই তার নির্দেশ দেওয়ারক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্র সমাজের ‘এজেন্ট’ হিসেবে জনগণেরঅধিকারসমূহ সৃষ্টি করে।
রাষ্ট্র জনগণ অপেক্ষা বড়ো হতেপারে না। ম্যাক্আইভার ধর্ম, নৈতিকতা, প্রথা ও সংস্কৃতিরওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন।
রাষ্ট্রের কাজ কর্মকে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ তথা কৃষি ও শিল্পের বিকাশ সাধনে সীমিত রাখার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন।
4. সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা: অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যান্ধি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রকাশিত শীর্ষক গ্রন্থ”The State in theory and practice’-এ রাষ্ট্রকে একটি জাতীয় সমাজ বলে অভিহিত করেন।
রাষ্ট্র আইন সংগত ভাবে বলপ্রয়োগের অধিকারী এই ক্ষমতা সার্বভৌমিকতা নামে পরিচিত। ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রকে সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে হয়।
জনগণের ব্যাপক অংশের সর্বাধিক পরিমাণ সামাজিক মঙ্গল সাধন রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ল্যাস্কি অবশ্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকে জনগণের শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সপক্ষে রায় দেন।