ইউরোপের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলোচনা করো ।
উত্তর : ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা কৃতিত্ব।
ভূমিকা : ইউরােপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হলেন মার্টিন লুথার। প্রকৃতপক্ষে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বের ধর্মসংস্কার আন্দোলন জার্মানিতে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে এবং এক ধর্মবিপ্লবে পরিণত হয়।
ইউরোপের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলোচনা করো।
১. লুথারের প্রাথমিক জীবন ও প্রতিবাদী মানসিকতার সূচনা : ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর জার্মানির ইসিলবেন গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ। উইলিয়াম ওকামের চিন্তাধারা ও অগাস্টাইনের বিখ্যাত বার দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
এরপর প্রথমে তিনি এরফুর্টের অগাস্টাইন মঠে যােগ দেন এবং মাত্র ২২ বছর বয়সে ধমর্যাজকের পদে অধিষ্ঠিত হন।
এই মঠে অবস্থানকালে বাইবেল ও অগাস্টাইনের বই পড়তে পড়তে প্রচলিত ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের দুনীতি উপলব্ধী করেন ও পীড়িত বােধ করেন। আর এই পীড়াপন্ডিত মার্টিন লুথারকে প্রতিবাদী মার্টিন লুথারে পরিণত করে।
২. উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে প্রতিবাদ : লুথার ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হয়। ক্যাথলিক চার্চ ও খ্রিস্টধর্মের অনাচারের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিখরা বক্তৃতা প্রদান করেন।
৩. রােমযাত্রা ও ধর্মীয় সংস্কারের প্রচেষ্টা : ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে লুথার ক্যাথলিক ধর্মের কেন্দ্রস্থল রােমে যান এবং সেখানে স্বয়ং পােপ ও ধর্মযাজকদের ভন্ডামী ও দুনীতি দেখে মর্মাহত হন।
তিনি পােপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভন্ডামী ও দুর্নীতি দূর করার আবেদন জানান, কিন্তু ব্যর্থ হন।
৪. রােম থেকে জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন ও মার্জনাপত্রের (ইনডালজেন্সের) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : রােম থেকে জার্মানিতে ফিরে এসে দুনীতি প্রতিকারের চিন্তা করতে থাকেন।
এই সময়ে রােমের সেন্ট পিটার্স গির্জার সংস্কারের অজুহাতে টেটুজেল নামে একজন রােমান যাজক জার্মানিতে এসে জনসাধারণের নিকট ইন্ডালজেন্স বা মার্জনাপত্র (মুক্তিপত্র) বিক্রি করতে শুরু করেন।
লুথার এই মার্জনাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মার্জনাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে ৯৫ দফা দাবি সম্বলিত একটি প্রতিবাদপত্র তিনি উইটেনবার্গ গির্জার দরজায় টাঙিয়ে দেন।
এবং তিনি বলেন— —অর্থ ব্যয় করে পাপ মােচন করা যায়না; অনুতাপের মধ্য দিয়েই পাপ মােচন সম্ভব।
৫. পােপ ও ধর্মযাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : মার্টিন লুথার ব্যাবিলনীয় দাসত্ব ও জার্মানজাতির খ্রিস্টান অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন নামক গ্রন্থে ক্যাথলিক চার্চ এবং পােপ ও ধর্মযাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন।
৬. পােপের নির্দেশনামাকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলা : লুথারের কার্যকলাপে অপমানিত ও ভীত হয়ে পােপ দশম লিও লুথারকে ‘ধর্মদ্রোহী’ বলে আখ্যা দেন এবং
ধর্মাধিষ্ঠান থেকে বহিস্কার করার কথা ঘােষণা করে লুথারের কাছে এক নির্দেশনামা পাঠান। লুথার প্রকাশ্যে এই নির্দেশনামাকে আগুনে পুড়িয়ে দেন। ও
৭. ওয়ার্মসের ধর্মসভা ও লুথার : সকলের সামনে লুথারকে দমন করার জন্য পােপের ইচ্ছানুযায়ী জার্মান সাট পঞম চার্লস জার্মানির ওয়ার্মস শহরে এক ধর্মসভার আয়ােজন করেন (২১শে এপ্রিল ১৫২১ খ্রি:)। এই সভায় লুথারকে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেন।
এই সভায় পঞম চার্লস লুথারকে তার মতবাদ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। উত্তরে লুথার বলেন যে, বাইবেলের উপর ভিত্তি করে কেউ যদি যুক্তি দিয়ে তার মতবাদ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করতে পারেন অবশ্যই তার মত ত্যাগ করবেন।
৮. লুথারকে হত্যার চেষ্টা ও লুথারের স্যাক্সনীতে আশ্রয় গ্রহণ : এই ধর্মসভায় লুথারের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে পঞ্চম চার্লস লুথারের লেখা সমস্ত গ্রন্থ সহ লুথারকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। সৌভাগ্যক্রমে স্যাক্সনীর শাসক ফ্রেডারিক তাকে আশ্রয় দেন।
৯. উইটেনবার্গ-এ লুথারের প্রত্যাবর্তন ও আন্দোলনের প্রসার : স্যাক্সনীতে থাকাকালীন লুথার জার্মান ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেন। পরে উইটেনবার্গে ফিরে এসে জার্মানিতে তুমুল আন্দোলনের সৃষ্টি করেন, এবং জার্মানিতে লুথার জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।