মার্কসবাদের মূলসূত্র গুলি আলোচনা করো ।

মার্কসবাদের মূলসূত্র

এমিল বার্নসের মতে, মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানবসমাজ সম্বন্ধে সাধারণ তত্ত্ব। এর নামকরণ হয়েছে কার্ল মার্কস-এর (১৮১৮ ১৮৮৩ খ্রি.) নামানুসারে।

এই মতবাদের মূলসুত্রগুলি হল—

1. দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল মার্কসীয় তত্ত্বের প্রধান ভিত্তি। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ থেকে উপাদান গ্রহণ করলেও তা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য হল জগৎ প্রকৃতিগতভাবে বস্তুময়। জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এই বস্তুজগৎ অনড় বা অচল নয়, তা সতত পরিবর্তনশীল। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি মৌলিক নিয়ম রয়েছে

1) বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরোধী ধর্ম একই সঙ্গে অবস্থান করে। তার ফলে দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। যেমন পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিমালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে।

2) পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে বিপরীতধর্মী শক্তিগুলির দ্বন্দ্বের ফলে বস্তুজগতে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনঘটে।

এই গুণগত পরিবর্তন বস্তুর আমূল পরিবর্তন ঘটাতেসাহায্য করে। মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আকস্মিকভাবে বিপ্লবের মাধ্যমে যে গুণগত পরিবর্তন ঘটে তার ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পত্তন হয়।

এভাবে সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে।

3. অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পুরাতনের অস্বীকৃতি ছাড়া নতুনের আবির্ভাব ঘটতে পারে না। নতুন ক্রমে পুরোনো হয় তখন তারও বদল ঘটে

এভাবে দাস সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করে সামন্তসমাজের বিকাশ, সামন্ত সমাজকে অস্বীকার করেপুঁজিবাদের বিকাশ, আবার পুঁজিবাদকে অস্বীকার করেসমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।

2. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: মার্কসের তত্ত্বের মূলনীতিগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

1) মূল কাঠামো ও উপরিকাঠামো: মার্কস সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, রাজনীতি-ধর্ম- দর্শন প্রভৃতি চিন্তাধারা নয়, সমাজের মূল কাঠামো বা প্রকৃত বুনিয়াদ হল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

এই বুনিয়াদের ওপর গড়ে ওঠে ধর্ম, নৈতিকতা, আইন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (যেমন রাষ্ট্র) ইত্যাদি যাবতীয় উপরিকাঠামো।

2) মানব ইতিহাসের পরিবর্তনের কারণ: মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে, মানবসমাজের বিকাশের ইতিহাস হল উৎপাদন- ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস। মানবসমাজের পরিবর্তনের মুখ্য কারণ উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন-সম্পর্কের দ্বন্দ্ব।

মার্কসের মতে, আদিম যৌথ সমাজজীবনে উৎপাদনের উপাদানের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় সমাজে শ্রেণিশোষণ ছিল না। দাস সমাজব্যবস্থায় দাসমালিকরা উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম করে।

ক্রমে সামন্ত সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক হল সামন্ত প্রভুরা। যন্ত্রশিল্পের উদ্ভব ঘটলে সামন্তসমাজের অবসান ঘটে এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব ও সংকট তীব্র আকার ধারণ করলে বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের অবসান এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটে।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সবরকম শোষণের সমাপ্তি ঘটে। এভাবে মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে সমাজবিবর্তনের ধারার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.