ঠান্ডা লড়াই সম্পর্কে আলোচনা করো | ঠান্ডা লড়াই শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন কে ?

ঠান্ডা লড়াই’ শব্দটি প্রথম প্রয়ােগ করেন বার্নার্ড বারুচ নামে এক মার্কিন কূটনীতিক। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটের যুদ্ধ-সংক্রান্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেন।

ঠান্ডা লড়াই সম্পর্কে আলোচনা করো

অবশ্য ঠান্ডা লড়াই’ সম্পর্কিত ধারণাটি মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান (Walter Lippmann) প্রথম প্রয়ােগ করেন বলে অনেকে মনে করেন।

ঠান্ডা লড়াইজনিত পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াশিংটন পােস্ট’- এ তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। পরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তা গ্রন্থাগারে The Cold War: A Study in US Foreign Policy নামে প্রকাশিত হয়। ঠান্ডা লড়াই বলতে এমন এক পরিস্থিতিকে বােঝায় যা ‘যুদ্ধও নয় শান্তিও নয়।

কাজেই ঠান্ডা লড়াই বা ঠান্ডা যুদ্ধকে যেমন প্রকৃত যুদ্ধ বলা যায় না তেমনি প্রকৃত শান্তিও বলা যায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখক জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল ঠান্ডা যুদ্ধ বলতে সাম্যবাদী মতাদর্শের সােভিয়েত ইউনিয়ন ও গণতান্ত্রিক মতাদর্শের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় ঘটনাকে বুঝিয়েছেন।

অধ্যাপক ফ্রিডম্যান মনে করেন, ঠান্ডা লড়াইকে ‘গরম লড়াই’-এর একটি প্রয়ােজনীয় স্তর হিসেবে দেখা ঠিক নয়। ঠান্ডা লড়াই হল যুদ্ধের এক নয়া কৌশল।

ফ্রিডম্যান- এর মতে, ঠান্ডা লড়াইয়ের অবস্থা বলতে প্রকৃত যুদ্ধের অবস্থাকে বােঝায় না। ঠান্ডা লড়াই হল এমন এক ধরনের পরিস্থিতি যেখানে যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধের জন্য সবরকম প্রস্তুতি জারি থাকতে দেখা যায়।

ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণ ?

ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির পিছনে কোনাে একটি কারণকে দায়ী করা যায় না।

এজন্য অনেকগুলি কারণ সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকরা ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির জন্য যে সমস্ত কারণগুলিকে চিহ্নিত করেছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল –

1. মতাদর্শগত বিরােধ: ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির একটি প্রধান কারণ হল সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতাদর্শগত বিরােধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে থেকেই এই বিরােধ শুরু হয়ে যায় বলে অনেকে মনে করেন।

2. টুম্যানের নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা: ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের মূলে একটি বড়াে কারণ ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যানের নীতি এবং মার্শাল পরিকল্পনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চে মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি টুম্যান সােভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরােধ করার নীতি প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন।

যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিভিন্ন অঞ্চলে সােভিয়েত প্রভাব নির্মূল করাই ছিল এই নীতির প্রধান উদ্দেশ্য।

একইসময়ে রাষ্ট্রপতি টুম্যানের পররাষ্ট্র সচিব জর্জ সি. মার্শাল ইউরােপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে একটি পরিকল্পনার কথা ঘােষণা করেন। এটি মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিতি লাভ করে।

3. পারমাণবিক প্রতিযোগিতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই বৃহৎ শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে পারমাণবিক প্রতিযােগিতা এবং পারমাণবিক প্রতিরােধ গড়ে ওঠে তার ফসল হল ঠান্ডা লড়াই।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকরা এটা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানকে আরও পর্যদস্ত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল না, বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র।

হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করে সােভিয়েত ইউনিয়নকে দেখানােই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।

4. পারমাণবিক প্রতিরােধ: পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযােগিতার দৌড় শুরু হলেও উত্তেজনা ও বিরােধের চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে তা কিন্তু যুদ্ধের রূপ নেয়নি।

কারণ দু-পক্ষই এটা ভালােভাবে জানত পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ধ্বংস অনিবার্য। এক পক্ষ পরমাণু অস্ত্র প্রয়ােগ করলে অন্য পক্ষ যদি তার সমুচিত জবাব দেয় তবে তার অর্থ ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

এভাবে দু-পক্ষের আণবিক শক্তির ক্ষমতা এক ধরনের প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। একে আণবিক প্রতিরােধ (Nuclear Deterrence) বলা হয়। এই আণবিক প্রতিরােধ দু-পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে প্রতিরােধ করে।

তার ফলে না যুদ্ধ না শান্তি অথবা এক ধরনের যুদ্ধহীন যুদ্ধের পরিবেশ গড়ে ওঠে। এই পরিবেশেই তৈরি হয় ঠান্ডা লড়াই।

5. সামরিক জোট গঠন: ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণ হিসেবে দুই বৃহৎ শক্তির নেতৃত্বাধীন সামরিক আঁতাত বা সামরিক জোট গঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পরে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয় সামরিক জোট ন্যাটো (NATO)।

মার্কিনি নেতৃত্বের সামরিক জোট ন্যাটো’র বিপরীতে কয়েক বছরের মধ্যেই (১৯৫৫ খ্রি.) সােভিয়েত নেতৃত্বে তৈরি হয় ওয়ারশ চুক্তি’ (Warsaw Pact)।

আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ‘আত্মরক্ষামূলক আঞ্চলিক ব্যবস্থা হিসেবে ঘােষিত হলেও ন্যাটো’র বিরুদ্ধে এক পালটা জোট তৈরি করে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

এভাবে দুই অতিবৃহৎ শক্তি সামরিক জোট তৈরি করে ঠান্ডা লড়াইকে আরও বিপজ্জনক স্তরে নিয়ে যায় বলে অনেকে মনে করেন।

ঠান্ডা লড়াই শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন কে ?

Ans: মার্কিন মুটনীতিবিদ বার্নার্ড বারুচ ।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.