বিশ্বায়নের প্রভাব ও ফলাফল আলোচনা করো: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলির কথা তুলে ধরা যেতে পারে-
বিশ্বায়নের প্রভাব ও ফলাফল আলোচনা করো ।
1. উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বিশ্বায়নের নীতি উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে।
এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস. হারমানের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী পৃথিবীর ২০ শতাংশ জনগণের আয়ের ফারাক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ৮২:১ হয়েছে।
2. বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে,
তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা তে ও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
3. কর্পোরেট বিশ্ব বা বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য-সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এমন কতকগুলি বিধান পালন করতে হয় যার ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নত দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলির মধ্যে ৬১ শতাংশ মার্কিনি সংস্থা, ৩৩ শতাংশ ইউরোপীয় সংস্থা এবং ২ শতাংশ জাপানি সংস্থা।
সারা বিশ্ব জুড়ে এই বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।
4. নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাত: বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাতের উদ্ভব ঘটেছে।
উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এর ফলে ধনী দেশগুলি কর্তৃক গরিব দেশগুলির শোষণ অব্যাহত রয়েছে।
উন্নত দেশসমূহের কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost)-সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ-সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ, কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেনের মতে, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।
5. কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের ফলাফল: আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশসমূহ যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস ( Structural Adjustment) – এ হাত দেয়, তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি করা হয়।
কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারি, দারিদ্র্য, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সমাজের অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণির মানুষরা।
6. সাংস্কৃতিক সমতার প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্ব জুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইন্টারনেটসহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন হতে বসেছে।
বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।