মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে ।

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে:

ভূমিকা : পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে বাবর ভারতে মােগল সাম্রাজ্যের যে ভিত্তি স্থাপন করেন, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই সেই মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

আর এই পতনের পিছনে একাধিক কারণ একযােগে কাজ করে।

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে ।

পতনের কারণ সমূহ : মােগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলিকে নিম্নে আলােচনা করা হল—

১. স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র : মােগল রাজতন্ত্র ছিল স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র। সেকারণে সাম্রাজ্যের সংহতি ও শাসন ব্যবস্থা সম্রাটের রাজনীতি জ্ঞান, নিষ্ঠা ও পরাক্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল।

কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী পর্বের দুর্বল সম্রাটদের আরামপ্রিয়তা, কর্মশৈথিল্য এবং রাজনীতি জ্ঞানহীনতার কারণে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রের মূল বন্ধন ক্রমশঃ শিথিল হয়ে যায়। ফলে সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন অনিবার্যহয়ে উঠে।

২. জনসমর্থনের অভাব : জনসাধারণের স্থায়ী সমর্থন ও আনুগত্যের উপর মােগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ফলে মােগল সাম্রাজ্যের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী।

৩. উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব : মােগল রাষ্ট্রব্যবস্থায় সিংহাসনের উত্তরাধিকার সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট আইন ছিল। একারণে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর থেকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

আর এই সূত্রে আমীর ওমরাহদের প্রতিপত্তি বাড়ে এবং দুর্বল ও অপদার্থ সম্রাটরা তাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভিত্তিটি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে।

৪. সামরিক সংগঠনে ত্রুটি : দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে মােগল সেনাবাহিনী গঠিত হওয়ায় তা জাতীয় বাহিনীতে পরিণত হতে পারেনি।

এছাড়া মােগল বাহিনীর বিশালতা ও হারেমে নর্তকী ও দাস-দাসীপূর্ণ চলন্ত শহরতুল্য মােগল বাহিনীর ধীরগতি মারাঠা ও শিখবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেনি।

৫. সাম্রাজ্যের বিশালতা : আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত মােগল সাম্রাজ্যের বিশাল ব্যাপ্তি মােগল সাম্রাজ্যের পতনের এক অন্যতম কারণ।

৬. নৌশক্তির অভাব : নৌ-বাহিনী গঠন সংক্রান্ত বাদশাহী উদাসীনতা মােগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। বিদেশী বণিকদের উদ্ধত আচরণ এবং পাের্তুগিজ জলদস্যুদের বে-আইনী কাজকর্ম প্রতিহত করার মতাে নৌ-শক্তি মােগল সম্রাটদের ছিল না।

৭. অভিজাতদের দলাদলি : প্রথমদিকে অভিজাত সম্প্রদায় ছিল মােগল সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ। কিন্তু পরবর্তীকালে ইরানি, তুরানি, হিন্দুস্থানী প্রভৃতি গােষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজেদের মধ্যে দলাদলি শুরু করে ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

ফলে অভিজাতদের সাম্রাজ্যবিরােধী কার্যকলাপ মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়।

৮. অর্থনৈতিক সংকট: আকবর পরবর্তী মােগল সম্রাটগণ সাম্রাজ্যকে সচল ও প্রাণবন্ত করে রাখার মতাে অর্থনীতি গ্রহণ করেননি।

অপরপক্ষে দরবার ও হারেমের ব্যয়বাহুল্য, শাহজাহানের আড়ম্বরপ্রিয়তা, ঔরঙ্গজেবের দীর্ঘমেয়াদ যুদ্ধবিগ্রহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি করে, যা মােগল সাম্রাজ্যের পতনকে আসন্ন করে তােলে।

৯. কৃষক অসন্তোষ ও কৃষক বিদ্রোহ : মােগল অর্থনীতির দুর্বলতা, মনসবদারি প্রথা ও জায়গিরদারি প্রথার সংকট-প্রসূত চাপের কারণে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

এই সূত্রে সৎনামী, জাঠ ও শিখ বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ফলে মােগল রাষ্ট্রের ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়।

১০. বৈদেশিক আক্রমণ : মােগল শাসনকালের সূর্যাস্ত পর্বের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলা বৈদেশিক আক্রমণ ও লাগামহীন লুটতরাজের দ্বারকে উন্মুক্ত করে দেয়।

নাদিরশাহ ও আহম্মদ শাহ আবদালীর বেশ কয়েকবার আক্রমণে শতবিচ্ছিন্ন ও সর্বতােভাবে বিধ্বস্ত মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.