প্রাচীন রোমের দাস ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ । : প্রাচীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাস বা ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন গ্রিসের পলিস বা নগররাষ্ট্রগুলিতে দাসপ্রথার যথেষ্ট। ব্যাপকতা ছিল।
প্রাচীন রোমের দাস ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ ।
তবে এই প্রথা সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল প্রাচীন রােমান সভ্যতায়। আসলে রােমান সভ্যতার। ক্রীতদাস ব্যবস্থা পূর্বতন গ্রিসের ক্রীতদাস ব্যবস্থারই ধারাবাহিক ফলশ্রুতি ছিল।
রােমান সাম্রাজ্যে প্যাট্রিসিয়ান বা অভিজাত শ্রেণি এবং প্লেবিয়ান বা সাধারণ মানুষ ছাড়াও তৃতীয় এক শ্রেণির মানুষ। ছিল যারা তাদের প্রভুর অধীনস্থ ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হত।
এই তৃতীয় শ্রেণিকেই বলা হত দাস বা ক্রীতদাস। রােমের বাসিন্দাদের একটি বড়াে অংশের মানুষই ছিল ক্রীতদাস। শত্রুদেশের যুদ্ধবন্দি সৈনিককে রােমানরা ক্রীতদাসে পরিণত করত।
তা ছাড়া ইউরােপের প্রায় সমগ্র অংশ তথা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে কেল্ট, জার্মান, থ্রেসিয়ান, কার্থেজিয়ান ও গ্রিকদের মধ্য থেকে রােমের অধিকাংশ ক্রীতদাস সংগ্রহ করা হত। রােমে বসবাসকারী ক্রীতদাসদের সন্তানও ক্রীতদাস হিসেবে প্রভুর অধীনে বড়াে হত।
*ক্রীতদাসপ্রথার ব্যাপকতা : রােমের বহু নাগরিকই কিছু কিছু সংখ্যক ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন। রােমান সম্রাট নিরাের প্রাসাদের কাজকর্ম করার জন্য ৪০০ জন ক্রীতদাস ছিল বলে জানা যায়।
কোনাে কোনাে ধনী রােমান নাগরিক ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন। বস্তুতপক্ষে, রােমের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ক্রীতদাসদের শ্রমনির্ভর হয়ে পড়েছিল।
রােমান সম্রাট ক্রীতদাস মালিকদের কাছ থেকে ক্রীতদাস রাখার জন্য কর আদায় এই আদায়ের বিনিময়ে সম্রাট ক্রীতদাসপ্রথাকে মদত দিতেন। ইতিহাসবিদ গ্রান্ট বলেছেন।
যে, “স্বাধীন রােমান নাগরিকরা ক্রীতদাসদের শ্রমের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন যে, তারা নিজেদের পােশাক পরা, স্নান করতে যাওয়ার সময় গামছা বহন করা, রান্নাবান্না প্রভৃতি অতি সাধারণ কাজগুলিও ক্রীতদাসদের সহায়তায় সম্পন্ন করতেন।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রােমের কৃষিকাজে বিপুল সংখ্যায় ক্রীতদাস নিযুক্ত ছিল। রােমের বেশিরভাগ ক্রীতদাসই ছিল বিদেশি এবং তাদের কেউ কেউ আবার উচ্চশিক্ষিতও ছিল।
*রােমের ক্রীতদাসপ্রথার বৈশিষ্ট্য: প্রাচীন রােমান। সাম্রাজ্যের ক্রীতদাসপ্রথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
1. ক্রীতদাস সৃষ্টি; রােমান সাম্রাজ্যে মানুষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ক্রীতদাসে পরিণত হত।
যুদ্ধবন্দি: রােমের অধিকাংশ কীতদাস ছিল পরাজিত শত্রুপক্ষের যুদ্ধবন্দি। রােমান সেনারা যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি, কারারুদ্ধ বা হত্যা করত। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি হওয়া ক্রীতদাসদের দ্রুত বাজারে এনে অন্যত্র বিক্রি করা হত।
দারিদ্র: কোনাে কোনাে দরিদ্র পিতামাতা নিজ সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। প্রাচীন ইতিহাসবিদ ডায়ােনিসিয়াস বলেছেন যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রােমান সম্রাট রােমুলাস রােমান পিতামাতাকে তাদের সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করার অধিকার দেন।
অনাথ: জন্মগ্রহণের পর বিভিন্ন কারণে পরিত্যক্ত শিশুদের বিক্রি করে দেওয়া হত।
ঋণভার: কোনাে দরিদ্র ঋণগ্রহীতা তার মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশােধে ব্যর্থ। হলে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সেই মহাজন ক্রীতদাসে পরিণত করত।
ক্রীতদাসের সন্তান: ক্রীতদাসদের অনেক সন্তান-সন্ততি ক্রীতদাসে পরিণত হত। ক্রীতদাসদের যেসকল সন্তান জন্মসূত্রে ক্রীতদাসে পরিণত : জন্মসূত্রে হত তারা ‘ভার্নি’ (Vernae) নামে পরিচিত ছিল।
2. অধিকার ও স্বাধীনতা বিহীনতা : রােমের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সেখানকার ক্রীতদাসরা ছিল সম্পূর্ণরূপে পরাধীন। তারা কোনাে ধরনের রাষ্ট্রীয় আইনের সুবিধা ও নাগরিক অধিকার পেত না।
ক্রীতদাসরা আইনগতভাবে কোনােরূপ সম্পত্তির অধিকারী হতে এবং বিবাহ করতে পারত না। ফলে পারিবারিক জীবনের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত এই ক্রীতদাসদের জীবনে বেঁচে থাকার কোনাে আনন্দ ছিল। না। রােমের সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিযুক্ত হওয়া বা সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণের অধিকার থেকেও ক্রীতদাসরা বঞ্চিত ছিল।
3. কাজকর্ম : ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুর গৃহ, খামারবাড়ি, কৃষিক্ষেত্র, ব্যাবসা ইত্যাদি দেখাশােনাসহ যাবতীয় পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলি সম্পাদন করত। রাতদিন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রভুর যাবতীয় কাজ করে দিয়ে ক্রীতদাস তার প্রভুর জীবন সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলত।
ক্রীতদাসদের শ্রমেই রােমের বিশালাকার প্রাসাদ, রাস্তাঘাট, সেতু, পয়ঃপ্রণালী প্রভৃতির নির্মাণকাজ চলত। কিন্তু অমানুষিক পরিশ্রম করা সত্ত্বেও প্রভুরা তাদের পেট ভরে খাবার ও পরনে পর্যাপ্ত পােশাক দিত না। অনাহারে, অর্ধাহারে দৈহিক শাস্তির দ্বারা তাদের শ্রমদানে বাধ্য করা হত।
4. প্রভুর সম্পত্তি : রােমের ক্রীতদাস এবং তাদের সন্তান- সন্ততি প্রভুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে গণ্য হত। প্রভুর কাছে। তার অধীনস্থ ক্রীতদাসের মূল্য ছিল গৃহপালিত পশুর সমান। প্রভু তার অধীনস্থ ক্রীতদাসকে অন্যত্র ভাড়া খাটাতে, বিক্রি করতে, এমনকি হত্যাও করতে পারত।
5. শাস্তি : ক্রীতদাসরা দাসত্বের দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে মাঝেমধ্যেই পালানাের চেষ্টা করত। পালানাের চেষ্টা করলে অথবা প্রভুর বিপুল কাজের বােঝা যথা সময়ে শেষ করতে না পারলে প্রভু তার ক্রীতদাসদের ওপর নানা ধরনের অমানবিক নির্যাতন চালাত।
চাবুকের আঘাত, উত্তপ্ত লােহার ছ্যাকা প্রভৃতি নির্দয় অত্যাচার ছিল ক্রীতদাসদের কাছে সাধারণ বিষয়। শারীরিক নির্যাতনের ফলে ক্রীতদাসের শরীরের নানা স্থানে ক্ষত হয়ে থাকত।